নিলুপমা এবং অনিন্দ্য ছোটবেলার খুব ভালো বন্ধু। তাদের ছোট থেকেই একসাথে বড় হয়ে ওঠা, স্কুলে যাওয়া সবই একসাথে।
অনিন্দ্য নিলুপমাকে ভালোবেসে নিলু বলে ডাকত আর নিলু ডাকতো অনি বলে। তারা একে অপরের খুব কাছের মানুষ ছিল। তারা একে অপরকে খুব ভালোবাসত। সবই বেশ ভালই চলছিল।
দেখতে দেখতেই ১৭ টা বছর কেটে যায় তাদের ছোটোবেলার।
তাদের বন্ধুত্ব টা ছিল খুব মধুর সম্পর্কের। তারা দুজন দুজনকে ছাড়া কোনো কাজই করত না। নিলুর কাছের মানুষ বলতে অনি ছিল।
কিন্তু এই বন্ধুত্বের মধ্যে হঠাৎ এক কালো ছায়া নেমে আসবে তাইবা কে জানতো? অনি এখন ১৭ বছরের। নিলুও তাই।
হঠাৎ বছর ১৭ পরে গ্রামের লোকেরা কোনো ভাবে জানতে পারে অনিন্দ্য নাকি আর পাঁচটা ছেলের মতন স্বাভাবিক নয়।
অনি ছোট থেকেই একটু মেয়েলি স্বভাব ছিল তার পুতুল খেলতে চুরি পরতে এবং মেয়েদের নানান ধরনের খেলা খেলতে তার ভালো লাগতো। বাবা মা তাকে এতদিন সমাজের থেকে আড়াল করে রেখেছিল। কিন্তু সত্যি কি আর চাপা থাকে চিরকাল? ঠিক তেমনি আজ অনির এতদিনের লুকিয়ে রাখা সত্যটা সবার সামনে ধরা পড়ে যায়। কথাটা পাঁচকান হওয়ায় অনির বাবা-মাকে গ্রামের লোকেরা তাদের গ্রামছাড়া করার সিদ্ধান্ত নেন।
কথাটা সকলে জানার পর অনিকে গ্রামের স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। গ্রামের লোকেরা তাকে অলুক্ষনে কুশাইতা এবং অন্যান্য ভাবে অনিকে অপদস্ত করতে থাকে। অনির এই অস্বাভাবিক স্বভাবের জন্য তার বাবা-মা কেউ নানানভাবে রাস্তাঘাটে অপমানিত হতে হয়।
এইদিকে নীলুর বাড়ির লোক নিলুকে ঘর বন্দী করে রাখে যাতে নিলু অনির সাথে মেলামেশা না করতে পারে। নিলু পাগলের মতন অনিকে দেখতে চাইছিল কারণ তাকে বলা হয়নি ঠিক কি জন্য অনির সাথে তাকে মিশতে বারণ করা হচ্ছে। এদিকে গ্রামের লোকেরা অনিদের বাড়ি ভাঙচুর করতে লাগে তাকে গ্রামছাড়া করার জন্য। অনির বাবা পেশায় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।তিনি হাতজোড় করে গ্রামের লোকের কাছে দুটি দিনের সময় নেন। তাই সেই রাতেই অনির বাবা সিদ্ধান্ত নেন অনির মামার সাথে অনিকে বাইরে পাঠিয়ে দেবে।
গ্রামের লোকের অত্যাচার এর জন্য ঠিক দুই দিন পর অনির মামার কাছে তার বাবা-মা বুকে পাথর চাপা দিয়ে তাদের ছেলে অনিকে তার মামার সাথে বাইরে পাঠিয়ে দেয়। সেদিন রাতে অনির মামা যখন অনিকে নিয়ে যায় তখন মাঝরাস্তায় এক গভীর জঙ্গলে অনিকে অন্যের কাছে বিক্রি করে দেয়। অনি যেতে না চাওয়ায় তার মামা তাকে বলে -“শোন তোর বাবার আদেশেই আমি এই কাজটি করেছি তোর বাবাই আমাকে টাকা দিয়েছিল তোকে অন্য জনের হাতে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য ।”
গভীর জঙ্গলে অনির আত্ম চিৎকার করেও কোন লাভ হয়নি।
সেদিন অনি ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি।
বছর পাঁচেক গড়িয়ে যায়। নিলু তখন সাবালিকা। সে এখন ২১। কলেজ ছাত্রী।
অবশেষে হঠাৎ একদিন নীলুর কলেজের সামনের চায়ের দোকানে অনি নীলুকে দেখতে পায়। অনি নিলু কে ঠিক চিনতে পেরেছি কিনা সেটা যাচাই করার জন্য অনেকক্ষণ ধরে তার বাঁ হাতের দিকে তাকিয়ে ছিল। কারণ নিলুর বাঁ হাতে একটি জরুল ছিল। অনি নিলুকে ঠিক চিনতে পেরেছিল। হাতের জরুল দেখায় অনি দৌড়ে নীলুর কাছে ছুটে যায়। উৎসাহে নীলু নীলু বলে চিৎকার করতে থাকে। এবং আবেগপ্রবণ হয়ে নীলুর হাতটি ধরে ফেলে। ঘটনাটা নিমিষের মধ্যে হওয়ায় নিলু বুঝে উঠতে না পেরে সে চিৎকার করে উঠে।
নীলুর চিৎকার শুনে এই অমানুষ অসামাজিক লোক অনিকে খুব খারাপভাবে মারধোর করে বাজে ভাষায় হিজরে বলে গাল দিয়ে দূর করে দেয়।
নিলু থমকে যায়। ঘটনাটা হঠাৎ হাওয়ায় নিলু কিছু বুঝতে পারছিল না। সেদিন রাতে নিলু ঘুমাতে পারিনি সারারাত দিনে হওয়া ঘটনাটি মনে করে গেছে। অনেক ভাবনার পর তার সন্দেহ হয়েছে যে সেই হিজরে টি আর কেউ না তার হারিয়ে যাওয়া বন্ধু অনি। যতক্ষণ সে বুঝতে পারল সে অনি ততক্ষনে অনিকে সে আর দেখতে পেলো না। প্রতিদিন সকালবেলা নিলু তার কলেজের সামনে সেই চায়ের দোকানে অনির জন্য অপেক্ষা করতো। দুইদিন অপেক্ষা করাই অনির কোনরকম দেখা সে পেল না। প্রায় পাগলের মতন খুঁজছিল সে অনিকে । ৫ দিন পর নিলু অনিকে দেখতে পায় এক রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের পাশে বসে আছে। তখন সে দৌড়ে গিয়ে বলে -“এই তুমি অনি না?”
অনি বলে- “না আমার নাম অনিন্দিতা।”
“তবে সেদিন তুমি আমায় নীলু নীলু বলে হাত ধরলে কেনো? নিলু একমাত্র অনি ছাড়া কেউ বলত না “, নিলু বলল।
“তো সেদিন আমায় চিনতে কেন পারলে না?” অনি বলল।
“ব্যাপারটা নিমেষের মধ্যে হয়ে যাওয়ায় আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি আমায় ক্ষমা করে দিও পারলে,” নীলু বললো।
(অনি হাত ধরে)”না না ক্ষমা চেও না।”
( কান্নায় ভরা চোখে নিলু )”তুমি একবার বলো তুমি আমার সেই অনি যাকে আমি পাঁচ বছর আগে হারিয়ে ছিলাম” ।
“হ্যা নিলু আমি সেই অনি” অনি বলল।
নিলু কাঁদতে কাঁদতে অনিকে জড়িয়ে ধরে বলে- ” তুমি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে আমি কত না তোমাকে খুঁজেছি কত বার তোমার সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছি কিন্তু আমাকে বাড়ি থেকে বেরোতে দিত না। আমি কারণ জিজ্ঞেস করায় বাবা-মা আমাকে বলতো তুমি নাকি অপয়া কিন্তু আমি ওসব মানি না তুমি আমার কাছের মানুষ ছিলে আছো আর থাকবে। আজ আর কেউ আটকাবে না চলোনা আমরা বিয়ে করে নেই। নতুন করে সব শুরু করি।”
অনি নীলুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চিৎকার করে বলে- ” নাহ!!! কোনদিনও না। এই কাজ আমি কোনদিনও করতে পারবোনা সমাজে আমাদের কোনোদিনও মেনে নেবে না, কোনদিনও না।”
বলে অনি দৌড়ে সেখান থেকে চলে যায়।
( আত্ম চিৎকার করে নিলু) অনি যেওনা!! অনি …. অনি…
নিলু বাড়ি ফিরে তার বাবা মাকে বলে -( উৎসাহে চোখে জল নিয়ে)- ” বাবা আমি জানো অনিন্দ্য কে খুঁজে পেয়ে গেছি । মা জানো আমি না অনিন্দ্যকে খুঁজে পেয়ে গেছি। এবার আর আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না। আমি অনিকে বিয়ে করতে চাই।”
নীলুর মা নীলুর গালে এক চড় মেরে বলল- ” তুই ওই হিজরের কথা কোনদিন মুখেও আনবি না ও একটা অলুক্ষুণে।”
না ওই হিজরে না ও আমার অনি । বলে নিলু কান্না ভেজা চোখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিলু রাত-বেরাত অনিকে খোঁজে ।
খুঁজে না পাওয়া নিলু তার সেই কলেজের চায়ের দোকানে রাত থেকে অপেক্ষা করে। সেদিন রাতে নিলু আর বাড়ি ফেরেনি।
রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যায় নিলু তখনও অনির অপেক্ষায়।
ভোর থেকে সকাল হয়ে যায় তখন নিলু হঠাৎ অনিকে দেখতে পায়। অনি তখন তার কাজে বেরিয়ে ছিল।
নিলু অনিকে ডাকায় অনি নীলুকে এড়ানোর চেষ্টা করে।
নিলু দৌড়ে অনির হাত ধরে বলে -” আমি জানি অনি আমাদের এই সম্পর্কটা সমাজ কোনদিনও মেনে নেবে না। চলো আমরা একসাথে মরে যাই। লোকের অত্যাচারে মরার চাইতে আত্মহত্যা অনেক ভালো।”
অনি আপত্তি করে। “দেখো আমার তো জীবন এমনিও শেষ তোমার তো এখন অনেক কিছু দেখা বাকি জীবনটা এত সহজ করে দেখোনা নিলু যেটা বাস্তব সেটাকে মানতে শেখো”, অনি বলে।
“না আমি আর কিছু দেখতে চাই না তোমাকে ছাড়া বাঁচলে তোমার সাথেই বাঁচব আর মরলেও তোমার সাথেই মরবো।
অনি নীলুকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু সে কিছু বুঝতে চাইছে না।
অবশেষে নীলু তার ভালোবাসার দিব্যি দিয়ে বলে –
“আমার ভালোবাসার দিব্যি রইল কাল তুমি ঠিক সকাল ৭ টায় চৌরঙ্গী মোড়ের পেছনের আম বাগানে দেখা করবে। বাকি কথা কাল বলবো।”
নিলু ভালোবাসার দিব্যি দেওয়ায় অনি নীলুর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।
কথা মতন সকাল ৭ টায় অনি সেখানে অপেক্ষা করে। নীলুর আস্তে একটু দেরি হয়। (নিলু আসে)
নিলু অনিকে তখন বলে – ” চলো না আমরা দূরে কোথাও চলে যাই।”
অনি বলল – “না এই সমজা আমাদের কোনো দিনও মানবে না। আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না।”
” তাহলে চলো মরি “, নিলু বলল।
অনি ও নীলুকে খুব ভালোবাসে। সেও আর কোনো উপায় না পাওয়া নীলুর সাথে মরার সিদ্ধান্ত নেয়।
“ঠিক আছে” ,অনি বলল।
তৎক্ষণাৎ নিলু তার ব্যাগ থেকে দুটো সিসি বের করে একটা অনিকে দেয় আর একটা নিজের কাছে রাখে।
“এটা কি?” অনি বলল।
“বিষ,” নিলু বলল।
মরার আগে নিলু অনিকে জড়িয়ে ধরে সমানে কান্না কাটি করতে থাকে আর বলে ” ভালো থেকো আমার ভালোবাসা।” অনি তার ভালোবাসার কপালে একটি পবিত্র চুম্বন দিয়ে বলে “চলো বেশি দেরি করলে লোক দেখে ফেলবে।”
বলে তারা সিসি খুলে একে ওপরের হাত ধরে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে।
সূর্যের আলো আরো তীব্র হয়েছে।
ধীরে ধীরে অনির জ্ঞান ফিরলো। মাথায় মরণ ব্যাথা । তখন সে দেখছে নিলু তার পাশে পরে আছে । অনি নিলু নিলু করে ডাকায় দেখে নীলুর শরীর ঠাণ্ডা,
কোনো সার নেই। অনির বেচেঁ ওঠা টা তার কাছে অদ্ভুত লাগে তাই সে ফেলে দেওয়া বিষের সিসি মাটিতে খুঁজতে থাকে।
বিষের সিসি খুঁজতে গিয়ে সে নীলুর হাতে একটি ছোট্ট কাগজ দেখে। অনি সেটি খুলে দেখে। দেখে নীলুর লেখা একটি চিঠি
অনি,
তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না অনি কিন্তু এই সমাজ আমাদের কোনদিনও এক হতে দেবে না। তাই আমি চলে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যখন এ চিঠিটি পড়বে তখন হয়তো আমি আর তোমার সাথে থাকবো না তুমি ভাববে তুমি বিষ খাওয়ার পরেও তুমি বেছে উঠলে কি করে! আসলে তুমি যেটা খেয়েছিলে সেটা একটি সাধারণ ঘুমের ওষুধ ছিল। আমি আমার ভালোবাসাকে কোনদিনও মারতে পারি না। ক্ষমা করো আমায় ভালো থেকো। আমাকে ভুল বুঝনা। ভালোবাসি।
ইতি
তোমার নিলু।
– শ্রেয়া পাল।
Sera sera sera
Sotti durdanto
KHub bhalo
Sera sera
Osadharon likhe6e bote