সালটা 1928,ভারতবর্ষে তখন ব্রিটিশের রাজত্ব। এই বছরই গঠিত হয় সাইমন কমিশন। সারা দেশেই কম বেশি আন্দোলন চলছে স্বরাজ অর্জনের জন্য। লাবণ্য আর রহমান ছোটবেলার খুব ভালো বন্ধু। তারা দুজনেই তখন খুব ছোট। তাঁদের ছোট থেকেই একসাথে বেড়ে ওঠা, স্কুলে যাওয়া, খেলাধুলা সবই। পার্থক্য শুধু এটাই যে, লাবণ্য হিন্দু আর রহমান মুসলমান। কিন্তু তারা একে অপরকে খুব ভালোবাসতো। কেউই কাউকে ছাড়া থাকতে পারতো না। লাবণ্য পড়তো গ্রামের একটি স্কুলে আর রহমান পড়তো একটি মাদ্রাসায়।
দেখতে দেখতেই জীবনের কুড়িটা বছর কেটে গেলো। রহমান আর লাবণ্য দুজনেই এখন সাবালক আর সাবালিকা, কলেজ পড়ুয়া। তাঁদের অজান্তেই মনের মণিকোঠায় কখন যেন তাঁদের এই বন্ধুত্ব টা ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে। তাঁদের এই সম্পর্ক ছিল খুবই মধুর। দুজনেই দুজনের সবথেকে কাছের মানুষ ছিল।
সালটা এখন 1945, পরাধীনতার প্রায় অন্তিম লগ্ন। ধীরে ধীরে পরাধীনতার নিশা কাটিয়ে স্বাধীনতার কুসুম ফুটতে শুরু করেছে। কিন্তু এরই পাশাপাশি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে লেগেছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। বিদেশী আগুন্তুকরা সাধারণ নিরীহ দেশবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে থাকে জাতপাতের আগুন। আর এই আগুনের আচ পোহাচ্ছিলো সুদূর কলকাতা মহানগরী থেকে ছোট খাটো প্রত্যন্ত গ্রামগুলিও। এই আচ থেকে বাদ গেলো না লাবণ্যদের গ্রামটিও। কিন্তু এসব কিছুর বাইরে তাঁদের দুজনের সম্পর্ককে নিয়ে নানা স্বপ্ন ঘিরতে থাকে লাবণ্যের রাত আর দিনগুলিকে। এভাবেই কেটে যেতে লাগলো সময়, দিন কি মাস তার হিসেব নেই!!
এলো 1946 সাল, সেই ভয়ঙ্কর সময় যখন চারিদিকে রব উঠলো দেশভাগের। হিন্দু মুসলমান অন্তরদ্বন্দে চারিদিক কেঁপে উঠলো। দুই সম্প্রদায় পরস্পরকে নিজেদের শত্রু বলে মনে করতে লাগলো। এর প্রভাব পড়লো রহমানের উপরও। মাদ্রাসায় পড়াকালীনই বহু বিপ্লবী সংগঠনের সাথে সে জড়িয়েছিল, ধীরে ধীরে গোড়া মুসলমান সংগঠনের সাথে মিশে গেলো সে। যখন লাবণ্য তাঁদের সম্পর্ককে নিয়ে নানা কল্পনায় মেতে আছে তখনি রহমান যেন ধীরে ধীরে দূর হতে লেগেছে। আগে রোজ রহমান লাবণ্যের সাথে বুড়ো বটতলায় দেখা করতো। ইদানিং তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। রোজ লাবণ্য সেই বটতলায় গিয়ে দাঁড়ায় আর রহমানের জন্য অপেক্ষা করে কিন্তু রহমানের দেখা মেলে না। সে পাগলের মতো খোঁজে তাকে। অবশেষে প্রায় পাঁচদিন পর সে রহমানকে দেখতে পায় নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছে। সে ছুটে যায়। জড়িয়ে যাওয়া গলায় বলে, ” কোথায় চলে গেছিলে তুমি? এখন আর দেখা করো না কেন আমার সাথে? ” রহমান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর নদীর দিকে ফিরে বলে, ” তোমার সাথে আমি দেখা করতে চাইনা। ” লাবণ্য অবাক হয়ে বললো, ” কেন? কি করেছি আমি? ” রহমান ধরা গলায় বলে, ” তোমার সাথে আমি মেলামেশা করতে পারবো না, এটা ধর্ম বিরুদ্ধ কাজ। তোমার আর আমার ধর্মে মিল নেই, তুমি সম্পূর্ণ অন্য জগতের মানুষ। সকল হিন্দুরা আমার শত্রু! তোমাদের লোকেরা দিনের পর দিন আমাদের ছোট করে রাখে, হত্যা করে, আমাদের কোনো অধিকার নেই। ”
লাবণ্য বলে, ” এসব তুমি কি বলছো? আমি তোমায় ভালোবাসি, আর আমি জানি তুমিও আমায় ভালোবাসো। ”
রহমান কম্পিত গলায় বলে, ” আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না! তুমি আমার সাথে আর দেখা করতে এসো না। আমি আজ তোমার থেকে অনেক দূরে, কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকলেও আমাদের মধ্যে আজ বিরাট ব্যবধান। আমি আমার সংকল্পে দৃঢ়। তুমি চলে যাও। ”
লাবণ্য বলল, ” ভালোবাসার মাঝে ধর্ম কখনো বাধা হতে পারে না রহমান। কিসের ব্যবধানের কথা বলছো তুমি ?” লাবণ্যের চোখ ছলছল করে উঠলো।
” আমি আর সেই আগের রহমান নেই লাবণ্য। তুমি যাকে চিনতে সে মারা গেছে। আমি হিন্দুদের ঘৃণা করি, এই স্বার্থপর হিন্দুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণই আজ আমার পথ। দলের ডাক পেলেই আমি এদের সবাইকে মেরে শেষ করবো। ”
লাবণ্য বললো, ” তুমি রহমান শব্দটার মানে জানো? আল্লাহর আরেক নাম রহমান, রহমান মানে করুণাময়, দয়াশীল। তুমি কিভাবে সাধারণ নিরীহ মানুষদের হত্যা করতে পারো? কাল যদি সুযোগ পাও তুমি কি আমাকেও মেরে ফেলবে? ”
রহমান বললো, ” তোমাকে আমি কখনো মারতে পারবো না লাবণ্য। তুমি সামনে এসে দাঁড়ালে আমি অস্ত্র ওঠাতে পারবো না। আমার হাত নিথর হয়ে যাবে। তুমি এখান থেকে চলে যাও লাবণ্য, চলে যাও হাত জোর করছি। ” লাবণ্যের বুঁকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো, একটা উষ্ণ রক্তের স্রোত বয়ে গেলো। সে তক্ষনি সেখান থেকে ছুটে চলে গেলো, দু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো অশ্রুধারা। অন্যদিকে রাজনৈতিক হাওয়া ক্রমশঃ গরম হয়ে উঠলো, চারিদিকে তখন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি।
এরপর বহুদিন কেটে গেলো। সেই যে লাবণ্য বুকভরা বেদনা নিয়ে চলে যায় রহমানকে ছেড়ে, আর ফেরেনি। বহুকাল দেখা হয়নি ওদের। 1946 সালের 16 অগাস্ট, মুসলিম লীগের নেতৃত্বে কলকাতায় ঘটলো এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ। বৌ বাজার স্ট্রিট, আপার সারকুলার রোড, বিবেকানন্দ রোড সব রক্তে রাঙা হয়ে উঠলো। সেখান থেকে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়লো এই হানাহানি। রহমানও জড়িয়ে গেল এদের সাথে। বহু জায়গায় লুঠপাট, বোমাবাজি হলো, বহু মানুষ আহত হলো। এরমি চললো বেশ কিছুদিন। বাতাসে শুধু রক্তের গন্ধ, চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ!
কিন্তু রহমানের মন ছিল খুব সংবেদনশীল, চারিদিকের এই মৃত্যু মিছিল দেখে তার মন কেঁপে উঠলো। চারদিকে বহুমানুষের কান্নায় তার মনের ভেতর দারুন মোচড় দিতে লাগলো। তার এসব কিছুকে কেমন অপ্রয়োজনীয় মনে হলো। ইচ্ছা করলো এসবকিছু ছেড়ে পালিয়ে যেতে। কিন্তু সে দলের সাথে প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ, তাই সে পারলো না। ঠিক হলো বাজার সংলগ্ন অঞ্চলে সন্ধে ও রাতের মাঝামাঝি সময়ে গোলা গুলি চালানো হবে। সে মনে মনে ঠিক করে নিলো – এই শেষ, এরপর সে আর কোনো খুনোখুনিতে থাকবে না।
সন্ধে হলো, চারিদিকে অন্ধকার নেমে এলো, বাজারে জ্বলে উঠলো আলো। লোকজনের ভিড়ের মধ্যে হঠাৎই রহমান ও তার দলের ছেলেরা রাইফেল, বন্দুক হাতে ঢুকে গোলাগুলি চালাতে লাগলো। প্রায় দশ মিনিট অনবরত গুলি চললো, চারিদিকে মৃতদেহ ছড়িয়ে পড়লো, ড্রেনগুলো দিয়ে রক্তের স্রোত বয়ে গেলো। তারপর রহমানের সঙ্গীরা ধীরে ধীরে জায়গাটা ছেড়ে চলে গেলো। চারদিক নিস্তব্ধতায় ঢেকে গেলো। একা রহমান বাজারে হেটে হেটে চারিদিক দেখতে লাগলো। হঠাৎই হাঁটতে হাঁটতে একটা মৃতদেহ দেখতে পেল, চুড়িদার পড়া, ওড়না দিয়ে মুখটা ঢেকে গেছে, রক্তে মাংসে লেপ্টে আছে। দেহটিকে ওর খুব চেনা মনে হলো, খুব চেনা। ও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো, ধীরে ধীরে ওড়না টা সরিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো। ওই মৃতদেহ টা লাবণ্যের। রহমানের হাত থেকে রিভলওয়ার টা পড়ে গেল। রহমান ধপ করে বসে পড়লো লাবণ্যের পাশে। দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো লাবণ্যকে, চোখ দিয়ে বয়ে গেলো অশ্রুধারা। কাপা কাপা গলায় রহমান বললো, ” আমি তোমায় মারতে চাইনি লাবণ্য। ” রহমানের বুকটা ফেটে পড়তে চাইল।
সে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, ” তুমি ঠিক বলেছিলে লাবণ্য, ভালোবাসার মাঝে ধর্ম বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। তোমার শরীর থেকে বেরোনো রক্ত আর আমার শরীরের রক্তে কোনো পার্থক্য নেই। ভ্রমের মধ্যে ছিলাম আমি। বরানগর, কলকাতা সহ সারা বাংলা আজ জ্বলছে লাবণ্য, সব জ্বলছে। এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমি গড়িনি, ওরা গড়েছে। ওরা আমার মতো হাজারো তরুণকে ভুল বুঝিয়েছে। হিন্দু মুসলিম, জাতপাত ভেদাভেদ সব মিথ্যে! আমাকে পিশাচও ওরাই বানিয়েছে। এই এত লাশের মধ্যে আমি বাঁচতে পারবো না লাবণ্য। আমাকে একটু তোমার ভেতর ঘুমোতে দেবে চুপটি করে? এই বারুদের গন্ধ জানে তোমার আমার অপূর্ন গল্পকথা। আমি তোমাকেও খুব কষ্ট দিয়েছি, পারলে আমায় ক্ষমা কোরো।”
ধীরে ধীরে রহমানের হাতটা এগিয়ে গেল রিভলওয়ার এর দিকে। রিভলওয়ারটি তুলে আস্তে আস্তে কপালে ঠেকাল, তারপর নিঃশব্দে ট্রিগারে চাপ দিয়ে দিলো। লাবণ্যের পাশেই পড়ে গেলো রহমানের নিথর দেহ। চোখের কোনায় শুধু জল লেগেছিলো। সে মরতে মরতে অষ্ফুট স্বরে শুধু বলল,”ইহলোকে না হোক, পরলোকে গিয়ে মিলবো দুজন… শুভরাত্রি লাবণ্য।।। ”
_____________________________________________________________________________
To get technology related quality blogs please visit our main website
E sadharon noy…..osamanyo ononyo
ভাষা হারিয়ে ফেলেছি,এতো সুন্দর লেখা দেখে ♥️♥️♥️