অপু চলে গেলেন। ফেলুদার মগজাস্ত্র আর ঝলসে উঠবে না। ‘অশনি সংকেতে’র নিবারণ পণ্ডিতকে মনে আছে ? অমন সাত্বিক ব্রাম্ভণ, নধরকান্তি শরীর, যজমানগিরি করে চলছিলো বেশ। সেই পণ্ডিত চোখের সামনে দেখলো, যুদ্ধ শুরু হলো কি হলো না, বাজার থেকে চাল উধাও হয়ে গেলো। মানুষ তার নীতিবোধ হারিয়ে বসলো। রক্তচোষক, নারীলোলুপের দল বেরিয়ে এলো পথে শিকারের সন্ধানে। বুভুক্ষু মানুষ তখন দুমুঠো চালের জন্য মাথা খুঁড়ে মরছে। এই ভীষণ মরণ-বাঁচন সময়ে অসহায়, ক্ষুধার্ত পণ্ডিতকে দেখে বুকের মধ্যে ধাক্কা লাগে। দাওয়ায় বসে দূর থেকে ভেসে আসা ঢেঁকিতে ধান ভাঙার শব্দ শোনে আর ভাবে, কেন এমন হয় ? যুদ্ধ এসে কেন কেড়ে নেয় মানুষের এই সহজ সরল জীবন ? তারপরই হনহন করে হেঁটে চলে দুমুঠো চালের আশায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের এই চরিত্রায়ণ আমাদের এক নিষ্ঠুর বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। আর ‘শাখাপ্রশাখা’র প্রশান্ত ? যতকিছু ভ্রষ্টাচার, মিথ্যাচার, স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে যেন এক জলজ্যান্ত প্রতিবাদ। থেকে থেকেই টেবিল চাপড়ে যেন বুঝিয়ে দিতে চায় ‘Stop this nonsense talk.’ ‘গণশত্রু’তে অন্য এক সৌমিত্র। বলিষ্ঠ, সত্যনিষ্ঠ। যে কোনো মূল্যের বিনিময়েও এক পা পিছু হটতে প্রস্তুত নন। মানুষ তাঁকে গণশত্রু বানিয়ে দিলো। একলা মানুষটা বুক চিতিয়ে শরীরটা টানটান করে তার মোকাবেলা করলেন। সত্যিটা তুলে ধরতেই হবে। এ যে তাঁর নৈতিক দায়িত্ব। ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবিতে কলেজের প্রফেসর। ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। সুখের সংসারে চিড় ধরলো মেয়ের মা এসে ঢুকে পড়ায়। একদিকে প্রচণ্ড আত্মসম্মানবোধ অন্যদিকে আত্মগ্লানি এই দুইয়ের টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে যে মানুষটাকে ছটফট করে উঠতে দেখি, সেটা আসলে আমাদের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা নিরীহ ভালোমানুষটা, একটু খোঁচা খেলেই যে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। আর নিজেই নিজের সর্বনাশ করে বসে। ‘কোনি’ ছবিতে ক্ষিদ্দা চিৎকার করে ওঠে ‘ফাইট কোনি, ফাইট।’ এখানে অন্য এক সৌমিত্র। লড়াকু, এক ইঞ্চি জমিও ছেড়ে দিতে প্রস্তুত নন। মানুষটার দৃঢ়তা, আপোষহীনতা, বেপরোয়া মনোভাব আমাদের ভেতরটাকে পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়ে যায়। এইরকম অজস্র ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রতিভার সাক্ষর রেখে গেছেন। তিনি ছিলেন আদ্যোপান্ত বাঙালী। বাংলার মানুষকে তিনি চিনতেন। বাঙালীর আবেগকে তিনি বুঝতেন। তাই তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বাঙালীর আশা আকাঙ্খা, দুঃখ যন্ত্রণা, বিরহ ভালোবাসাকে যেমন মূর্ত হয়ে উঠতে দেখি, তেমনি ভণ্ডামি, নষ্টামি, বঞ্চনা, শঠতা এই সবকিছুরও ছায়া অনিবার্যভাবে এসে পড়ে। পরিণত বয়সে তাঁর অভিনয় যেন আরও সংযত, আরও গভীর, আরও ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠেছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন জাত শিল্পী। তাই যে কোনো জাত শিল্পীর মতো তাঁর ক্ষমতা বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েনি, শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে নিজেকে আরও পরিব্যাপ্ত করেছে।
থিয়েটারের সঙ্গে ছিলো তাঁর আশৈশব সখ্যতা। প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি থিয়েটারের জন্য সময় বার করে নিয়েছেন। পেশাদারী মঞ্চে দীর্ঘদিন অভিনয় করেছেন। মানুষ যখনই তাঁকে ডাক দিয়েছেন তাঁদের নিজস্ব মঞ্চে, সব কাজ ফেলে ছুটে গেছেন। মঞ্চশিল্পের প্রতি এই ঐকান্তিক আকর্ষণ আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে তাঁর প্রতিভা এককেন্দ্রিক হয়ে থেমে থাকতে চায়নি, বিচ্ছুরিত হয়েছে এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে। শম্ভু মিত্র বলতেন, ভালো অভিনয় জীবনের অনেকগুলো স্তরকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত চরিত্রগুলি জীবনের দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক স্তরগুলোকে অনায়াসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে।
তাঁর কলম সচল ছিলো শেষবেলা পর্যন্ত। এইতো ক’দিন আগেও তাঁর কলম দিয়ে বেরিয়ে এসেছে এমন সব লাইন, যার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে কবির সাম্প্রতিক জীবনবোধ, তাঁর দর্শন, তাঁর মনন, সর্বোপরি তাঁর কাব্যিক মেজাজ। সে ছিলো একটা সময়, তিনি নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে সম্পাদনা করেছেন ‘এক্ষণ’। যাঁদের হাতে এই পত্রিকা কখনও পৌঁছেছে, তাঁরাই একমাত্র জানেন কতটা যত্ন, কতটা পরিশ্রম, সাহিত্যের প্রতি কতটা অনুরাগ থাকলে এই ধরণের সাহিত্যসম্ভার পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব। ভালোবাসার ভিতটা তৈরী হয়েছিলো
বোধকরি শৈশবেই। ‘এক্ষণ’ হাতে নেবার পর থেকে তা আরও সোচ্চার হলো, আরও পরিশীলিত, আরও সৃষ্টিশীল। বাঙালী পেয়ে গেলো কবি সৌমিত্রকে।
বাচিক শিল্পী সৌমিত্র আমাদের আর এক প্রাপ্তি। তাঁর অনন্য কণ্ঠস্বরে যখন রবীন্দ্র কবিতা শুনি, কিম্বা জীবনানন্দ, কিম্বা জয় গোস্বামী বা তাঁর নিজস্ব কিছু রচনা, মোহাবিষ্ট হয়ে সেই কবিতার শরীরের মধ্যে প্রবেশের দ্বার যেন উন্মুক্ত হয়ে যায়।
কবিতার পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে যে গভীর ব্যঞ্জনা, ভাঁজে ভাঁজে বয়ে চলে যে জীবনের স্রোত, সেইসব কিছু আমাদের সামনে একটা অশরীরি অবয়ব নিয়ে হাজির হয়। আবেগে আপ্লুত হয়ে আমরা দেখি, কী অক্লেশে, কী অনায়াস দক্ষতায় অনুপম কণ্ঠের দোলানিতে তিনি বুনে চলেন সৌন্দর্যের রূপমাধুরী। আকণ্ঠ পান করেও কেবলই মনে হয় ভারি এক অতৃপ্তি রয়ে গেছে।
চল্লিশ দিন একটানা লড়াই করেছেন তিনি। না, ডাক্তাররা শেষ রক্ষা করতে পারেন নি। তাঁরা হেরে গেছেন। জীবনটায় দাঁড়ি টেনে দিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আমরা, যাঁরা রয়ে গেলাম তাঁর গুণমুগ্ধ, আমাদের কানে ঝমঝম করে বাজতে থাকবে, কেবলই বাজবে তাঁর সেই সুললিত কণ্ঠস্বর ‘ আবার আসিব ফিরে …………।’
Wow i just amezed….kono kotha hobe na
Sera khub sundor
Khub sundor likhechen…..
Osadharon lekha sotti Mon chue gelo
হৃদয়স্পর্শী ❤️