প্রতিদিনের বাঁধাধরা জীবনপঞ্জিকা ছেড়ে বাইরে দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা সবারই থাকে। বাবা মায়ের রােজকার বকাবকি, টিউশন স্যার কিংবা স্কুলের টিচারদের কড়া আদেশ আর পানিশমেন্টের উঁচু পাঁচিল টপকে কোথাও হারিয়ে যেতে পারলে কতই না ভালাে হতাে। বাবা যখন বায়না করা জিনিসগুলাে দিতে চায়না, খুব বকা দেয় কিংবা মা যখন পরীক্ষার খাতার বড় বড় রসগােল্লাগুলাে দেখে সারা দিনরাত কানের সামনে ১৮.৩ এফ.এম, ইরিটেটিং বাজাতে থাকে তখন সত্যি মনে হয় বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাই। সব বাঁধন ছিড়ে মুক্ত হই। এই আকাশে,
আমার মুক্তি আলােয় আলােয়”
এখন এত বড় বড়ড়া চিন্তা ভাবনা মাথায় আসলেও ছােটবেলায় একটা চাপা ভীতি মনের ভেতর থেকেই যেত। মায়ের আঁচল আর বাবার কড়ে আঙুল বাড়ির বাইরে এই ছিল আমার প্রথম এবং একমাত্র সঙ্গী। এদের ছেড়ে বাড়ির বাইরে একটা পদক্ষেপ ফেলতেও যেন বুক শিউরে উঠত। সব সময় পদক্খলনের ভয় লাগত। মনে হত, এই বুঝি নিষ্ঠুর পৃথিবীর ভয়ঙ্কর অচেনা মানুষগুলাে আমাকে কেড়ে নেবে, দূরে সরিয়ে দেবে বাবা মা-এর থেকে। তাই স্কুলে একা একা কাটানাে দুই-তিন ঘণ্টাও যেন প্রচন্ড ভয় আর আতঙ্কে কাটত। দুই-তিন ঘণ্টাকে যেন দুই-তিন দিনের চেয়েও বড়াে বলে মনে হত। স্কুল ছুটির পর যেন আমার করুণ চোখ দুটো সভয়ে খুঁজে বেড়াত বাবা মাকে। সেই সময় বাবা মাও আমাকে নিয়ে বেশ ভয়েই থাকত। স্কুলে ভিড়ে বা রাস্তায় যাতে হারিয়ে না যাই, তাই বারবার করে বলে দিত, ‘বাবা, রাস্তায় কোনো অচেনা লােকের সাথে কথা বলবে না, হ্যাঁ। কেউ কিছু দিলে একদম নেবে না। তাছাড়া ব্যাগে আর গলায় তাে আইডেনটিটি কার্ড থাকতই। তা সত্ত্বেও হারিয়ে যাওয়ার একটা ভীতি আমার মধ্যে তাে ছিলােই, এমন কি বাবা-মায়ের মধ্যেই ছিল।
তবে এই ভীতি যে আমার বাস্তব জীবনে কিছুক্ষণের জন্য অন্ধকার নামিয়ে আনবে তা ভাবিনি কোনােদিন। ঘটনাটা ঘটেছিল ক্লাস প্রি-তে। সেবার আমার দিদি বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়ায় আমরা স্বপরিবারে কলকাতা যাই প্রাই নেওয়ার জন্য। সেখানে গিয়ে রবীন্দ্রভবনে প্রাইজ নেওয়া, ছবি তােলার পর্ব শেষ করে যখন হলঘর থেকে বাইরে আসি তখন স্বভাবতই আমি বাবার কড়ে আঙ্গুল ছাড়িনি, হঠাৎ করে কেমন অদ্ভুত একটা সন্দেহের বশেই বাবার দিকে তাকাই, আর তাকাতেই আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। বাবার জায়গায় এটা কে? কার হাত ধরে আমি এতক্ষণ হাটছি? তবে কি আমি হারিয়ে গেলাম? মাথায় যখন এইসব প্রশ্ন এক একটা বৃহৎ ব্রহ্মদৈত্যের মত হানা দিচ্ছে তখন খুব সাহস করে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলাম। সাহস করে কান্না বিষয় দুটো না মিলললেও সেদিন কান্নাই আমাকে বাবা-মার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিল। চোখ বুজে অঝােরে কাঁদতে কাঁদতে যখন চোখ খুললাম, দেখি বাবা, মা, দিদি আমার সামনে দাঁড়িয়ে। দেখামাত্র আমি বাবাকে জাপটে ধরে কেঁদে ফেললাম আবার, বারবার।
তখন এই হারিয়ে যাওয়া ব্যাপারটাকে ভীষণ বেদনাদায়ক মনে হত। কিন্তু এখন ভাবি, ইস! যদি এই বয়সে এরকম হারিয়ে যেতে পারতাম তাহলে কতই না ভাল হত। রােজকার একঘেয়েমি জীবন সংগ্রাম থেকে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও শান্তি পেতাম। নিজের খুশি মত যেদিকে ইচ্ছে হত যেতে পারতাম, যা মনে হত খেতে পারতাম। পছন্দের জিনিসগুলােকে খুব কাছ থেকে যতক্ষণ খুশি দেখতে পারতাম, তাড়া দেওয়ার বা বকা দেওয়ার কেউ থাকত না। কিছুক্ষণের জন্য আমি হতাম স্বাধীন। আমার সেই জীবনের কিছুটা মুহূর্ত আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারতাম। ধর্ষণ, খুন, র্যাগিং, ইভটিজিং, অ্যাসিড অ্যাটাক এইসব জঘন্য ঘৃণ্য অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারতাম।
কিন্তু বর্তমানে মনে ইচ্ছে হলেও উপায় নাই। খবরের কাগজ পড়ে মাঝে মাঝে মনে হয় হারিয়ে যাই। হারিয়ে গিয়ে সমাজের কালাে মুখােশ গুলাে টেনে ছিড়ে ফেলি, চেষ্টাও করি প্রতি পদে পদে ব্যর্থ হই। এখনকার যুগের অবস্থা দেখে বাবা-মাও আর আমায় একা ছড়তে সাহস পায় না। সব সময় সাথে সাথে থাকে। চোখের সামনে অন্যায় হতে দেখলেও প্রতিবাদ করতে পারি না। অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে যাই আর বাবা মা পেছনে থেকে আমায় টেনে ধরে।
তাই এখন আমাদের মতাে মেয়েরা হারিয়ে যেতে চাইলেও পারে না। আসল কথা হল, আমাদের হারিয়ে যেতে দেয় না আমাদের সমাজ, আমাদের বাবা মা। সমাজ ভয় পায় যে যদি আমরা হারিয়ে যাই তাহলে সমাজের ভালাে দিক গুলাে সবার সামনে আসবে। আর বাবা মা ভয় পায়, হারিয়ে গেলে হয়তাে আমাদের নাম খবরের কাগজে বা টিভি চ্যানেলে দেখবে।
“কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়া নেই মানা ”
রবি ঠাকুরের গান সমাজে জনপ্রিয় হলেও আমাদের কাছে তাই অর্থহীন হয়েই থেকে যায়…
Khub sundor
Valo laglo pora
❤️
ALSO READ THIS YOU LOVE IT
Link: https://daakevents.com/golpo-srot-short-story-ayan-kar/